বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও প্রতিবছর ১০ অক্টোবর বিশ্বমানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছরের মত এবারেও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ এবং বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে মাসব্যাপী বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস-২০২১ উদযাপনএরআয়োজনকরেছে। এই  উপলক্ষে ১০ অক্টোবর,২০২১খ্রিঃ রবিবার সকাল ১১:০০টায় এ বছরের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। এই ওয়েবিনারটির আলোচ্য বিষয় হলো ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’। 

শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান জোবেদা খাতুন বলেন, শারীরিক স্বাস্থ্যের মত মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা প্রয়োজন। তবে বিশ্বজুড়েই মানসিক্ স্বাস্থ্য বিষয়টি অবহেলিত হয়ে আসছে। তিনি এ ব্যাপারে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। স্টিগমা ও কুসংষ্কার দূর করে প্রতিটি মানুষের কাছে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করেন। কমিউনিটি লেবেলের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন।

এরপর আজকের ওয়েবিনারের মূল প্রতিপ্রাদ্য বিষয় সর্ম্পকে আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটির সভাপতি ড. মোহম্মদ মাহমুদুর রহমান। তিনি তাঁর আলোচনায় বলেন ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’ – আমরা দু’ধরণের বৈষম্যের সন্ধান পাই: প্রথমত, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুক্তভোগী এক বিশাল সংখ্যা, যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকা জনিত বৈষম্য, এবং (২) স্ব-স্ব রাষ্ট্রের প্রশাসনিক নীতিমালার ফলে সৃষ্ট একই দেশের বিভিন জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর্থ সামাজিক বৈষম্য, জীবনযাত্রার সকল চাহিদা ও মান বজার রাখার অক্ষমতা, ইত্যাদি হতে সৃষ্ট  মানসিক চাপ বৃদ্ধি  এবং  নানা প্রকার মানসিক সংকটে ভোগা ও সংকটপূর্ণ জীবনযাপন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, কোভিড-১৯ মহামারির আর্থ-সামাজিক প্রভাবেও দেখা গেছে যে, দারিদ্র ও বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রকোপও অতিমাত্রায় বেড়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ১৭ ভাগ মানুষ কোন না কোন মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে, এর মধ্যে মাত্র ৮% মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে ও ৯২% মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা হতে। এই পরিস্থিতি দূর করতে একদিকে যেমন  বাড়াতে হবে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার মান, তেমনি অন্যদিকে মানসিক চাপ ও মানসিক স্বাস্থ্যহানির গভীর কারণসমূহ দূর করার জন্য নিতে হবে গবেষণালব্ধ কার্যকর স্ট্রাটেজি, যেখানে আমাদের জাতীয় লক্ষ্য হতে হবে আগামী দশ থেকে বিশ বছরের মধ্যে দেশে মানসিক রোগীর হার ৭% এ নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করা।

ওয়েবিনারে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। বিশেষ অতিথি তাঁর বক্তব্যে বলেন যে,  করোনাকালীন সময়ে বৈষম্যহীনতা পরিষ্কারভাবেই বিশ্বজুড়ে ফুটে উঠেছে। যার প্রভাব আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা গিয়েছিল এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূণ ভূমিকা রেখেছিল। করোনাকালের বৈষম্যকে বিবেচনা করলে গেøাবাল নর্থ ও গেøাবাল সাউথ, এই দুটো ক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইস, যে দেশগুলো ফ্যাসিলিটিজের দিক থেকে অগ্রসর সেই দেশগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে জনসাধারনের দোড়গোড়ায় সহজে যেতে পারছে বিভিন্ন এ্যাপস নিয়ে। কিন্তু তা আমাদের গ্রাম অঞ্চলে সম্ভব হয়নি। মানুষের মধ্যে স্যোসাল ও ফ্যামিলি যে কোহেশনটা দরকার তা বর্তমানে ঘাটতি, সেটা বহুলাংশে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যার ফলে মানসিক চাপ মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছেনা এবং আমাদের উৎপাদনশীলতা, তা কলকারখানাতে  হোক বা ব্যক্তিগত জীবনে হোক কমে আসছে এবং ব্যক্তিগত জিডিপিতে এর প্রভাবটা লক্ষণীয়। তিনি বলেন, ভূটানের একটা আইনে আছে সরকার যদি জনগনের মধ্যে সুখ নিশ্চিত করতে না পারে তবে সেটা ভাল সরকার নয়। তাই সরকারকে এই ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে,আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে তাদের উপযোগীক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে।

‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’ শীর্ষক এই ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব মোঃ সায়েদুল ইসলাম বলেন, এক অসম বিশ্বে প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, এমন একটি সময় অতিক্রান্ত করছি, সেটিও আমাদের একটি অসমতা সৃষ্টি করছে। আমরা জানি যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রয়েছে যেখানে স্বাস্থ্যের একটি সংজ্ঞা রয়েছে। সেই সংজ্ঞাতে বলা আছে যে “ঈড়সঢ়ষবঃব ঢ়যুংরপধষ ধহফ সবহঃধষ বিষষনবরহম” এটাকেই স্বাস্থ্য বলে। মানুষের শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণরূপে যে স্বাভাবিকতা ও সুস্থতা সেটাকেই স্বাস্থ্য বলে। তিনি বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নের মধ্যে বাংলাদেশ যাচ্ছে। ‘নো বডি বিহাইন্ড’- এখানেও সমতার বিষয়টি এসেছে। অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, বাংলাদেশ অর্জন করেছে এসডিজি প্রোগ্রাম এ্যাওয়ার্ড। আমি মনে করি প্রিভেনশন ইজ কিওর- এই প্রতিরোধের জন্য অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। হতাশা, কর্মস্পৃহা, মানসিক চাপকে শিশুকাল হতে এ্যাড্রেস করা হলে এই অস্থিরতা, প্রতিযোগিতা ও বৈষম্যদূর করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন প্রত্যাশা ও প্রতিযোগিপতির উপর সন্তুষ্টি ও প্রাপ্তির গুরুত্ব নির্ভর করে। পিিপ্তরকে এক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে কাজ করে ইতিবাচক মানসিকতা সৃষ্টি করার প্রতি তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন।

আজকের ওয়েবিনারে সভাপতি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক  এ, কে, এম, শামীম আক্তার বলেন, প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বেযেখানে ক্রমাগত সমাজের অসম বন্টনের বিষয়টি রয়েছে, একই সাথে চলমান কোভিড পরিস্থিতির অভিঘাত সবচেয়ে বেশী আঘাত হেনেছে সমাজে তুলনামূলকভাবে কম সুবিধা ভোগী বা নিম্ন, নিম্নমধ্যম, মধ্যম এমনকি উচ্চ মধ্যম আয়ের শ্রেনীর মানুষদের। এই অভিঘাত যতটা না আর্থিক তারচে বেশী মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে বিশেষ করে কিশোর-যুব ও নারীদের। এ বিবেচনায় এ বছরের প্রতিপাদ্য যথার্থতা সহজেই অনুমেয়। তিনি আরও বলেন, প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বের অনিবার্য পরিনতি যে অসাম্য বা সামাজিক অসমতা-তার অভিঘাতে সৃষ্ট মানসিকভাবে অস্থিরতা ও সমস্যাক্রান্ত বাংলাদেশের জনগণ বিশেষত: যুবসমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ্য মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে কার্যকর, কৌশলী ও প্রয়োগমূখী করার ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এছাড়া ১০ অক্টোবর, ২০২১ রাত ৮.০০ টা এবং ৯.৩০ টায় মানসিক স্বাস্থ্য ও এবারের প্রতিপাদ্যের উপর দুটি Facebook live অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ২৯ ও ৩০ অক্টোবর এবং ৫ নভেম্বর ২০২১ তারিখে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনলাইন জুমে অনুষ্ঠিত হবে গুরুত্বপূর্ণ ও যুগোপযোগী আরো ১১টি কর্মশালা। কর্মশালা সমূহের মধ্যে রয়েছে:

১.    আপনি কি নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট? আমাকে নিয়ে আমি যেভাবে ভালো থাকতে পারি

২.    মনোজগতের পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে কি জীবনের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব?

৩.    আমাদের জীবনের গল্প আমরাই সাজাই: আত্মহত্যা প্রতিরোধ করি

৪.    Neuropsychological Consequences of Stroke

৫.    জীবনকে ভালোবাসুন- মানসিকভাবে সুখী ও অর্থপূর্ণ জীবনগড়ুন

৬.    দুই প্রজন্মের সেতুবন্ধনঃ দূরত্ব নয় বন্ধুত্ব

৭.    করোনাকালে সন্তান প্রতিপালনে আপনি কী করবেন?: কিছু অহিংস কৌশল জানুন

৮.   করোনায় মানসিক সুস্বাস্থ্য: কী করতে পারি আমরা?

৯.    নারী ও পুরুষের মনো:যৌন সমস্যা: মনোবৈজ্ঞানিক সমাধান ও করণীয়

১০.   Borderline Personality Disorder: Myths and Reality

১১.   রোমান্টিক সম্পর্কের উন্নয়ন: আপনার করণীয় কি?

উক্ত আয়োজনে অংশগ্রহণের জন্য আপনাকে/আপনাদেরকে আমন্ত্রন জানাচ্ছি।

ধন্যবাদান্তে

জোবেদা খাতুন
চেয়ারম্যান
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়